ময়নামতি লালমাই বিহার - কুমিল্লা

 শিক্ষার ও সাংস্কৃতির শহর কুমিল্লা। প্রাচীন-পুরাতত্ত্ব সমৃদ্ধি কুমিল্লা। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, কালের-সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লালমাই বৌদ্ধ বিহার। এর প্রবেশদ্বার পেরিয়ে চোখ থমকে যায় বিষ্ময়কর রাজ্যে। কত অজানা-অধরা-রহস্যবানী লুকিয়ে আছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে। কুমিল্লার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। বাংলাদেশের মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নাম কুমিল্লা।

কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক স্মৃতি জুড়ে আছে এখানে। ময়নামতি সেনানিবাসে কমনওয়েলথ যুদ্ধসমাধিসহ আছে স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর। শহরের উপকণ্ঠে কোটবাড়িতে আছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ ও ময়নামতি যাদুঘর।

এখানে কেউ এলে, প্রথমেই যেতে হবে ময়নামতি লালমাই পাহাড়ে। শহর থেকে ৮ কি. মি. পশ্চিম-দক্ষিণে লালমাই। অষ্টম ও দশম শতকের দেববংশ ও চন্দ্র বংশের রাজত্ব কালে এখানে এক প্রাচীন সভ্যতা রচিত হয়। লালমাই পাহাড় ঘিরে তারই অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ।

আমরা যখন যাই আকাশে মেঘ ছিল। মাঝে মাঝে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। আবার মেঘ-ভাঙ্গাঁ রোদ ছড়িয়ে পড়েছিল লাল ইটের লালমাই পাহাড়ে। কর্তৃপক্ষ সুন্দর শোভায় সাজিয়ে রেখেছে পাহাড়ের অবতল। একপায়ে বাঁধানো পথ পাহাড়ের চারপাশে। দর্শনার্থীরা আছেন সারাক্ষণ। হাঁটছেন, পাহাড়ে উঠছেন আর ছবি তুলছেন। শিশু-বৃদ্ধা, নারী-পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রী সব বয়সের সবাই আছেন এখানে। পুরানো অতীতকে খুঁজে পেতে চান তাঁরা।

প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার, সে এক ইতিহাসের রহস্যময় পাতা। চোখের সামনে ইতিহাসের পাতাগুলো উল্টে-পাল্টে দেখা। পাল আমলের অভিনব স্থাপত্যকর্ম এখানে কালের সাক্ষী। কুমিল্লা শহর থেকে মাত্র ৮ কি.মি. দূরে কোটবাড়ি। বৌদ্ধভিক্ষুরা দলে দলে এখানে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য বৌদ্ধধর্ম প্রচার। সেই সব ভিক্ষুদের আশ্রম সারিসারি কক্ষগুলো। ভিক্ষুদের স্মৃতি স্মারক এই ধ্বংসস্তুূপের উপরে জেগে থাকা বিহারগুলো।

বাংলার স্থাপত্যশিল্প শতশত বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। পাল আমলের বৌদ্ধ বিহারগুলো তাদের অন্যতম। পাহাড়পুর, ময়নামতি লালমাইপাহাড়ের বৌদ্ধ বিহারের নকশা ও স্থাপত্যশৈলী অভিনব। ময়নামতি শালবনবিহারের আনন্দ টিলা বাঙ্গালি সংস্কৃতির নবতর সংযোগ।

ধারনা করা হয়, পাহাড়পুর বিহারের কিছু পরে ময়নামতির শালবন বিহার প্রায় কাছাকাছি আদলে নির্মিত হয়। এর আকৃতি বর্গাকার। দৈর্ঘ্য-প্রস্তে পাঁচশো ফুট। প্রাচীর সংলগ্ন সারিবদ্ধ কক্ষ। কক্ষের সংখ্যা ১১৫। কেন্দ্রে আছে ক্রস চিহ্নিত একটি মন্দির। মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ায় প্রকৃত উচ্চতা হারিয়ে গেছে।

বৌদ্ধ বিহারগুলোর নির্মাণ কাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক। প্রায় চারশো বছর ধরে বিহারগুলো নির্মিত হয়েছে। ময়নামতি বিহারে প্রাপ্ত মূর্তিগুলো ব্রোঞ্চের এবং সবগুলো বুদ্ধমূর্তি। পাথরের তৈরি বেশকিছু মূর্তি আবিস্কৃত হয়েছে। এগুলোও দেখতে বেশ সুন্দর। এদের মধ্যে মহাযান ও বজুথানপন্থী বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তিও আছে। ময়নামতীর এই মূর্তিগুলোর উপকরণগত বৈশিষ্ট্য আলাদা। বাংলার অন্যান্য বিহারগুলোর মূর্তি রাজমহলের কালো পাথর দিয়ে তৈরি কিন্তু ময়নামতীর মূর্তি তৈরি হয়েছে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাটির পাথর দিয়ে।

ময়নামতি বিহারে শতশত পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। এগুলোয় রয়েছে প্রাচীন বাংলার চমৎকার লোক শিল্পের নমুনা। এগুলোয় খচিত আছে নানাজাতের চিত্র। যেমন নানা ভঙ্গিতে নারীপুরুষ, পশুপাখি, জীবজন্তু, দেবদেবী, দৈত্যদানব প্রভৃতি। এই বিহারে প্রাপ্ত অন্যান্য জিনিসপত্রের সংখ্যাও কম নয়। এগুলোর মধ্যে আছে বারোটি তাম্রলিপি, ২২৭টি স্বর্ণমুদ্রা, ২২৪টি রৌপ্যমুদ্রা, ব্রোঞ্চের তৈরি মূর্তি, ঘণ্টা ও অন্যান্য জিনিস। আছে ব্রোঞ্চের ¯ূ‘পও। স্বর্ণমুদ্রাগুলো গুপ্ত যুগের। এছাড়াও পাওয়া গেছে বাগদাদের আব্বাসীয় বংশের দুটি স্বর্ণমুদ্রা। এই মুদ্রার তৈরি সময় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। এ থেকে অনেক খানি আভাস পাওয়া যায় এই বিহার কতোদিন টিকে ছিলো। সবচেয়ে বড় কথা বাংলার স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের ইতিহাস জাড়িয়ে আছে লালমাই বিহারকে ঘিরে।












0 comments: