ভয়াল সুন্দর সুন্দরবন

ভয়াল সুন্দর সুন্দরবন

Sundarbans the mystic mangrove forest in Bangladesh
মুস্তাফিজুর রহমান
এই ভোরে কী যে ঠাণ্ডা লাগে, হাড় পর্যন্ত জুড়িয়ে যায়। একটু পরই হাঁটুসমান কাদাপানিতে নামতে হবে ভেবেই কি তোমার উপর শীত আরো জেঁকে বসছে? ট্যুর কোম্পানির পাতলা চাদরটা অনেক আপন ভেবে আরেকটু জড়িয়ে নিলেও তরুণ ফটোগ্রাফারদের জ্বালায় একটু দেরি করে উঠবে সে উপায় তো নেই, দরজায় টোকা “বস্‌, ছয়টা বেজে গেছে”, গলাটা আখলাসের, ওকে চেনো? হাওড় অঞ্চলের মানুষ এখন সিলেটে স্থায়ী, ওর ঝুলিতে ছবি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সংখ্যার হিসাব সে নিজেও জানে না। আস্তেধীরে উঠে আসো, গলায় মাফলার জড়িয়ে দরজার সামনের দুই ফুট খোলা প্যাসেজে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নাও, মন জুড়িয়ে যাবে। এখানে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাও, বুঝতে পারবে ভাটায় পানি প্রায় পাঁচ ফুট নেমে গেছে, পাশে আমাদের লঞ্চের সাথে বাঁধা ইঞ্জিনবোটের ভেজা ছাদে দেখো ইতোমধ্যেই বসে গেছে কয়েকজন, মাহবুব আর মফিজ ভাইকে দেখো সাবধানে বোটে পা রাখছে, আবার না পিছলে যায়!
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে মাথা ঝিমঝিম করছে? কিছু না, গতরাতে দেড়টা পর্যন্ত খোলা ছাদে বসে আড্ডা মারার ফল। আচ্ছা, আড্ডার বিষয় মনে আসছে না কেন? শেষ কবে এমন আড্ডা হয়েছিলো তা কি মনে করতে পারবে? আমি জানি পারবে না। ঢাকার জীবনে আড্ডার কথা মনে থাকে না, তবে আমি বলে দিলাম নাগরিক কোলাহলের বাইরে সুন্দরবনে কাটানো এই কয়টা দিনের কথা আজীবন মনে থাকবে তোমার। বোটে ওঠার মুখেই ফ্লাক্সে গরম চা দেখে এক কাপ হাতে নেবার ইচ্ছা থাকলেও সাবধান, একটু আগেই লীলেনদাকে বলতে শুনেছি “শালারা চায়ে চিনির বদলে লবণ দিয়েছে”।
তোমার আর চা খাওয়া হবে না। এই যে তোমার হাতে বিস্কিট ধরিয়ে গেল ওর নাম রাশেদ, কুটকুট করে দুটো বিস্কিট শেষ হতে না হতেই দেখো নৌকা ভরে উঠছে, ভেজা ছাদে এক এক করে আসন পেরে বসছে তুষার, শাওন, অরূপ, জিলাল, আলমগীর, সাদিক সবাই। আমার জন্য প্লাস্টিকের চেয়ার আসাতে হাসি পাচ্ছে তোমার, তাতে কী? দেখো সে চেয়ার নিয়ে অবলীলায় আমি বসে যাচ্ছি নৌকার একদম সামনের দিকে।
Shrubs in low tide
লঞ্চের আড়াল থেকে নৌকা সামনে চলে এসেছে। সামনের দিকে তাকাও, কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর উপর, শীতের ভোরে গ্রামে খোলা চুলায় রান্না বসালে যেমন ধোঁয়া আসে ঠিক তেমনি ধোঁয়া উঠছে পানি থেকে, ভাটার নদী এখানে এখন ৫০ হাত চওড়া হবে কিংবা একটু বেশি, দৃষ্টি এখানে বেশিদূর পাবে না, কিন্তু চোখ মেলে দেখো রঙ আর ছায়ার কী অপরূপ খেলা, নদীর পানি, দুপাশের কালচে কাদা তারপর সবুজ হলুদ বন, সবই কেমন নীলাভ মায়াবী আলোয় মিশে আছে, একশ হাত দূরে সবই দেখো নীল হয়ে আছে আর তারপর থেকে কী অদ্ভুতভাবে সবই হয় সাদা না হয় কালো।
20101226-_Q8X0297-1
খুব ছবি তুলতে ইচ্ছা করছে তাইনা? তাহলে ডান দিকে তাকিয়ে বসো, নৌকা এখন ডান পাড় ঘেঁষে যাচ্ছে। চিকন রুপালি নদী, নৌকা থেকে দশ হাত দূরে মাটি দেখা যায়, এই কাদা, মাটি আর পানির মিলনরেখায় বক খাবার খুঁজছে, ছবি তুলবে? থাক বরঞ্চ আরেকটু উজানে তাকাও, বিশাল পাখিটা দেখতে পারছো না? তুমি বরং এদের লম্বা সাদা লেন্স বরাবর তাকাও, হ্যাঁ হ্যাঁ এটা, এটার নাম মদনটাক, আস্তেধীরেই তোলো, ক্ষুধার্ত পাখি সহজেই উড়ে যাবে না। এই ফাঁকে তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র দেখার সবচাইতে ভালো সময় ভোরবেলা যখন ভাটা থাকে। সবাই তখন খাল নদীর কাছাকাছি চলে আসে খাবারের খোঁজে, পানি বাড়তে থাকলে, বেলা বাড়তে থাকলে আস্তে আস্তে ভেতরে চলে যায়। আরে ঐদিকে দেখো সব ক্যামেরা একসাথে ক্লিক ক্লিক করে উঠছে, দেখতে পাচ্ছো? হুঁ হুঁ আমিও পারছি, একটা, দুইটা, তিনটা, আরে আরে একটু ভেতরে তাকিয়ে দেখো অগুনতি হরিণ, সাথে বানর, কেওড়া ফলে নাস্তা সারছে। খেয়াল করে দেখো ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখলেও সরে যাচ্ছে না ভয়ে।
20101224-_Q8X0064-1
আমরা পশ্চিমে এগুচ্ছি, একটু পরই সামনে যে বাঁকটা দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে ডান দিক দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে আবার পুবে চলে আসবো। দেখো দেখো বাঁকটা তো অসম্ভব সুন্দর, পেছন থেকে সূর্যের আলো পরে বাম দিকের গাছ গুলো ঝিকিমিকি করছে, তাই না? কী বললে? গাছের নাম? ও হ্যাঁ, এগুলো “কেওড়া”, নিচের ছোটোগুলো “গরান”, সামনের ঝিলিক দেয়া গাছটা সম্ভবত “জানা”, আর এই যে বিশাল সাইজের ঝুমকার মত ফল ঝুলে আছে এটা গোলপাতা। আর ঐটা, হুম, শোন, আমরা এখন নিষিদ্ধ এলাকায়, বাঘের অভয়ারণ্য এটা, সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ এখানে, তারই সাবধাবাণী দিয়ে সাইনবোর্ড। তার সামনে দেখো গরান গাছের ফাঁকে পতাকা ঝুলে আছে একটা, হ্যাঁ, ছেঁড়া লুঙ্গি দিয়ে বানানো পতাকা, বাঘ যেখান থেকে কোনো মানুষ ধরে নিয়ে যায় তারই আশেপাশে উঁচু ডালে সেই হতভাগ্যের সঙ্গীসাথীরা একটা কিছু ঝুলিয়ে রাখে অন্যদের সাবধান করার জন্য। বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার, তাই না? একটু সামনে বায়ে তাকাও, গরান গাছের গোড়া থেকে পানি পর্যন্ত কাদায় ফুটখানেক চওড়া দাগটা খেয়াল করো, এই ভাটাতেই একটা বাঘ এখান দিয়ে খাল পেরিয়ে ওপারে গিয়েছে, এবারে ডানে তাকাও, ঠিক এই দাগটা বরাবর উল্টোদিকে দেখো বাঘ লাফিয়ে পানি থেকে ডাঙায় ওঠার চিহ্ন রেখে গেছে। আর এই ঝনাৎ শব্দ? আমাদের গার্ড মজিদ আর সুমন তাদের রাইফেল ঝাঁকিয়ে নিলো নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশের সতর্কতা হিসাবে।
20101226-_Q8X0313-1
ভয় ভয় লাগছে তোমার বুঝতে পারছি, কিন্তু পাড় ঘেঁষে ঐ ছোটো নৌকার দিকে তাকাও, দুজন মানুষ কাদায় একের পর এক বাক্স বসিয়ে যাচ্ছে, এগুলো কাঁকড়া ধরার ফাঁদ, এক ভাটায় বসিয়ে আরেক ভাটায় তুলে নিবে। জোয়ারে ভেসে আসা কাঁকড়া খাবারের লোভে আটকা পড়বে খাঁচায়, ওরা ধরে ধরে জমাবে নৌকার খোলের ভেতর, ৩/৪ দিন পর পর মহাজনের ইঞ্জিন নৌকা এসে কাঁকড়া নিয়ে যাবে বিনিময়ে মিলবে এদের খাবার। ওরা থেকে যাবে সুন্দরবনে। আত্মরক্ষার জন্য ওদের সম্বল কেবল ইঞ্চি ন’য়েক লম্বা দা। আশ্চর্য হচ্ছো তাইনা, নৌকা কাছে আসুক বুঝতে পারবে কতটুকু গরিব হলে মানুষ এরকম বিপদসংকুল পেশা বেছে নেয়? দুই তিন প্রস্থ গরম কাপড় জড়িয়েও যেখানে ঠাণ্ডা লাগছে তোমার সেখানে দেখো একজন রীতিমত হাঁপাচ্ছে, হাঁপানি আছে নিশ্চয়ই, এই ঠাণ্ডাতে আরো বেড়েছে মনে হয়। পাশের খাকি প্যান্ট পরা লোকটার কথা বলছো? না, সে ফরেস্টের কোন গার্ড না, হয়ত তাদের ফেলে দেয়া পোশাক পরনে, খেয়াল করো সেই প্যান্টের চেইন নেই, বোতাম নেই, একটা চিকন দড়ি দিয়ে কোমরের সাথে বাঁধা, আমাদের দেখে ছেড়া গেঞ্জি টেনে নিচে ঢেকে দেবার কী আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে!
20101226-_Q8X0320-1
তুমি জানতে চাইলে আমরা কোথায় যাচ্ছি। আসলে কোথাও যাচ্ছি না আমরা। রাতে আমাদের লঞ্চ যেখানে নোঙর করেছিলো তার ডান দিকের যে বন তার চারদিকেই নদী কিংবা খাল। একটা বৃত্তের মত নৌকায় সে নদী খাল ঘুরে আমাদের নোঙর করা জায়গাটার উল্টোদিকে কাদায় নামবো আমরা, সেখান থেকে সোজা বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আবার এপারে চলে আসবো। এ নিষিদ্ধ এলাকায় এভাবে ঘোরার রোমাঞ্চ নিশ্চয় টের পাচ্ছো এখন, তুমি আরো রোমাঞ্চিত হবে শুনলে যে আমাদের গাইড কিংবা গার্ড কিংবা ফটোগ্রাফারদের কেউই এ রাস্তা চেনে না, শুধু আমি ছাড়া। এই ভোরে আধো আলো আঁধারিতে একবার পথ হারালে বিপদ, সারাদিন ঘুরতে হবে খালে খালে। ঐ যে সামনে শুকনো খাড়িমতন দেখা যাচ্ছে, নৌকা আমাদের সেখানে নামিয়ে ফিরে যাবে। ঐদিক দিয়েই ভেতরে ঢুকবো আমরা।
সাবধানে নেমে এসো। কাদা যদি হাঁটুর উপরে উঠে যায় খবরদার সামনে এগুনোর চেষ্টা করবে না, যতই চেষ্টা করবে দেখবে আস্তে আস্তে দেবে যাচ্ছে পা। হাঁটু দেবে গেলে কাদায় জোর চলে না। আর খেয়াল করে পা ফেলবে, এখানকার কাদা পিচ্ছিল, একবার পিছলে গেলে বিপদ, নির্ঘাত নিচ থেকে বর্শার মতন উঠে আসা শুলে ক্ষতবিক্ষত হতে হবে। দৃষ্টি রাখবে নিচুতে, প্রতি ইঞ্চিতে এখানে বিপদ, সাধারণ নিরীহ শুকনো পাতার নিচেই পড়ে আছে বিষাক্ত কাঁটা। ঠিক আছে এই লাঠিটা হাতে রাখতে পারো, তাতে ভর দিয়ে হাঁটতে সুবিধা হবে তোমার। কাদা পেরিয়ে সবার নেমে আসার অপেক্ষায় একটু দাঁড়াও, একসাথে ঢুকবো আমরা, এক লাইনে, কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে সবার।
নিশ্চয়ই তোমার এবারকার প্রশ্ন হবে কেনো এলাম আমরা এখানে। এর উত্তর পাবে একটু পরই, সামনের ছোটো ছোটো গাছগুলো সরে যেতে দাও, এবারে একটু এপাশে এসো, তাকাও সামনের দিকে, চোখ মেলে দেখো কী অপার্থিব সৌন্দর্য চারদিকে, এ সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, পৃথিবীতে এমন সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গা কেউ দেখেছে বলেও জানি না। চুপ করে বসে থাকো, মন খুলে গান গাও কিংবা আলতো পা ফেলে ঘুরে বেড়াও। এ স্মৃতি রয়ে যাবে আজীবন, একদিন বয়স হলে পরবর্তী বংশধরদের কাছে আসর জমিয়ে গল্প করতে পারবে এ ভয়াল সৌন্দর্যের। যাই করো শুধু একটি কথাই ভুলে যেয়ো না তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো ঠিক তার পাশেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার হেঁটে যাবার টাটকা ছাপ দেখা যায়।.......................................................

1 comments:

elmira said...

very beautiful country, and salaaam