বৈচিত্র্যপূর্ণ নান্দনিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সমাহার
একটি আদর্শ পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে যেসব উপকরণ থাকা দরকার তার সবটুকু যেন রয়েছে এখানে পাহাড় ও নদীর মিলন মেলা, সবুজের সমারোহ, নীল পানির দীঘি, চীনামাটির খনি, আদিবাসীদের (গারো, হাজং, আচিক এবং মান্দি ইত্যাদি) জীবনযাত্রা খুব কাছে থেকে দেখা যাবে, দেশের সর্ব বৃহৎ সিরামিকের পাহাড়, নদী থেকে কয়লা ও পাথর উত্তোলনের দৃশ্য, আদিবাসী কালচারাল একাডেমি, মন্দির ও গির্জা, বিখ্যাত বালিশ মিষ্টি এবং বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত রেখা (জিরো পয়েন্ট) ইত্যাদি।
যদিও অবকাঠামোগত ভাবে বিরিশিরি ও দুর্গাপুর অনুন্নত, তারপরও এর নান্দনিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সৌন্দর্য একে অনন্য ও আদর্শ পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
পর্যটন বিষয় নিয়ে পড়াশোনার সুবাদে গবেষণাধর্মী কাজের জন্য এমনিতেই প্রচুর পরিমাণে পরিচিত ও সম্ভাব্য পর্যটন স্থানগুলোতে ভ্রমণ করতে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত বৎসর আমি ও আমার কিছু বন্ধু (নাজমুল, মাহবুব, অরিন, সেতু, কান্তা, ফারজানা ও ছন্দা) মিলে গিয়েছিলাম বিরিশিরি ও দুর্গাপুরের ওপর কিছু গবেষণা ও জরিপের কাজ করতে।
বিরিশিরির মূল আকর্ষণের মধ্যে একটি হলো বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড়। ছোট-বড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমি জুড়ে প্রায় ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এই খনিজ অঞ্চল। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে এই অঞ্চলে সাদামাটির পরিমাণ ধরা হয় ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা বাংলাদেশের তিনশ’ বৎসরের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
চীনামাটির পাহাড়গুলো মূলত সাদা রঙের। তবে কিছু কিছু জায়গায় মেরুন বা হালকা লাল রঙ বিদ্যমান। পাহাড় থেকে মাটি তোলায় সেখানে হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ হ্রদ্রের পানির রঙ নীল। কিছু কিছু জায়গায় সবুজাভ নীল। কিছু জায়গায় সাদা, কিছু জায়গায় লাল।
এই নীল রঙের পানি দেখে যে কারোই গোসল করার সাধ জাগতে পারে, এই যেমন আমাদের মধ্যে থেকে নাজমুল ও অন্য একটা গ্রুপ থেকে আরো কয়েকজন উপর থেকে লাফ দিয়ে পানির মধ্যে পড়ছিল, তখন তাদের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন অন্যরকম কিছু একটা জয় করে ফেলেছে যা আমাদের মতো ভীরুদের পক্ষে সম্ভব না।
আসামের মেঘালয় রাজ্যর গারো পাহাড়ের গাঁ ঘেষে বয়ে যাওয়া সোমেশ্বরী (পূর্বে ‘সমসাঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল) নদীর বিচিত্রতা ও সৌন্দর্য চোখে পরার মতো। একদিকে যেমন এর স্বচ্ছ পানিতে যে কারোর হাত বারিয়ে একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা হবে, অন্যদিকে পানির ভিতর কয়লার ও নুড়ি পাথরের স্তূপ দেখে চোখ জুড়িয়ে আসবে। সারাদিন স্থানীয় দিন-মজুররা এই নদীতে কয়লা ও পাথর তোলে। দিন শেষে তা স্থানীয় মজুতদারদের কাছে বিক্রি করে।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই জায়গাটি অবকাঠামোগত ভাবে অনুন্নত হওয়াতে এখানে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াতের মাধ্যম হচ্ছে মোটরসাইকেল ও রিকশা। যদি আপনি রিকশায় ঘুরে বেড়াতে চান তাহলে আপনাকে প্রতি দুই জনের জন্য ৬-৭ ঘণ্টায় ভাড়া বাবদ গুনতে হবে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকার মতো আর যদি মোটরসাইকেলে যান তাহলে দিতে হবে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকার মতো। এভাবে আপনি দু’দিনের মধ্যে বিরিশিরির সব পর্যটন স্থান ঘুরে আসতে পারবেন।
বিরিশিরিতে মূলত যেসব পর্যটনস্থান রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড় ও নীল পানির দীঘি, সোমেশ্বরী নদী, রানীখং গীর্জা, গারোসহ অন্যান্য আদিবাসীর জীবনযাত্রা ও কালচার, আদিবাসী কালচারাল একাডেমি, সাগর দিঘী, কুল্লাগড়া মন্দির, বিজিপি ক্যাম্প ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রেখা।
হাতে দু’দিন সময় নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ঢাকা থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার উত্তরে সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর ও বিরিশিরি থেকে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বিরিশিরির উদ্দেশে বাস ছাড়ে। ভাড়া পড়বে ২০০ টাকার মতো। বিরিশিরির বাস বলা হলেও সোমেশ্বরীর ব্রিজের কাজ শেষ না হওয়ায় বাস থেকে নামতে হবে সুখনগরীতে। সেখানে ৫ টাকা দিয়ে নৌকায় ছোট নদী পাড় হয়ে ওপাড় থেকে মোটর সাইকেল, রিকশা, টেম্পু, বাসে দুর্গাপুর যেতে হবে।
রাস্তা এক কথায় জঘন্য। এজন্য মোটর সাইকেলই সুবিধাজনক। প্রতি মোটর সাইকেলে ২ জনের জন্য ভাড়া নেবে ১০০ টাকা। রিকশা ৮০-১০০ টাকা, টেম্পু/বাস জনপ্রতি ২০ টাকা। তবে ব্রিজের কাজ শেষ হলে আপনাকে বাস সরাসরি বিরিশিরি গিয়ে নামিয়ে দেবে।
কোথায় থাকবেন ও কি খাবেন
অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় এখানে তেমন কোনো ভালো মানের হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস ও কোনো রেস্টুরেন্ট তেমন ভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে মোটামুটি থাকার জন্য বেশ কয়েকটা হোটেল ও গেস্টহাউস রয়েছে যা আপনাকে খুব কম খরচে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। এদের মধ্যে YWCA ও YMCA রেস্ট হাউজ, কালচারাল একাডেমির নিজস্ব রেস্ট হাউজ ও জেলা পরিষদ ডাক বাংলো, হোটেল স্বর্ণা একটু ভাল মানের। কেবল YWCA রেস্ট হাউজ ছাড়া অন্য হোটেল বা গেস্টহাউসগুলোতে রেস্টুরেন্ট ফ্যাসিলিটিস না থাকায় আপনাকে মেইন রাস্থার পাশে অবস্থিত যেকোন রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নিতে হবে।
থাকা খাওয়ায় একটু আধটু ঝামেলা থাকালেও পাহাড়ের কূল ঘেষে বয়ে যাওয়া নদীতে ছোট্ট নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানোর সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হবে দূর থেকে দূর দিগন্তে। এ যেন বিধাতার এক অপার কৃতি যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
আর একটা কথা সাথে করে ছাতা, নরম জুতা বা স্যান্ডেল, পানির বোতল, ক্যাপ নিতে ভুলবেন না।
0 comments:
Post a Comment